পহেলা ফাল্গুনঃ বসন্তের উষ্ণতায় আমের মুকুল আজ মঞ্জুরিত-গুঞ্জরিত
রিয়াজুল ইসলাম প্রিন্স,এসবিডি নিউজ২৪ ডট কমঃ প্রকৃতির নিয়মে ‘দখিন সমীরণের শিহরণ’ জাগানোর মাহেন্দ্র দিন আজ। মাতাল হাওয়ায় কুসুম বনের বুকের কাঁপনে, উতরোল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, নিরাভরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে উঠার আভাসে, পল্লব মর্মরে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে_ ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে..।’ ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা/ এসো হে এসো হে এসো হে আমার বসন্ত’_ কবিকণ্ঠের এ আহ্বানের লগন এলো। মাতাবে আপন মোহে। ভালোবাসায় ঝঙ্কার আনবে। আজ যে বসন্ত। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। আজ পহেলা ফাগুন। প্রভাতের নবীন ঊষা বাংলার প্রকৃতিতে ঋতুরাজের দোলা নিয়ে এসেছে। মানব-মানবীর হূদয় বেদি আর পশু-পাখি, প্রজাপতির রঙিন পাখনা, মৌমাছির গুনগুনানি, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে, শাখে-শাখে, ঘাসে-ঘাসে, নদীতটে, কুঞ্জ বীথিকায় ও অরণ্য-পর্বতে নবযৌবনের বান ডেকেছে। সকালের ঘুমভাঙানি দক্ষিণা সমীরণে কেটেছে শীতের জরাগ্রস্ততা। জেগেছে আশ্চর্য শিহরণ। জারুল-পারুল, মাধবী-মালতী-রজনীগন্ধা, পলাশ-জবা, কৃষ্ণচূড়া-দোপাটি, কনকচাঁপার গুচ্ছ আন্দোলিত হয়েছে নবজীবনের স্পন্দনে। আড়মোড়া ভাঙানিয়া বসন্ত বাতাসে হিল্লোলিত হয়েছে আম্রকুঞ্জ। নবপত্রে ও পুষ্পে বন-বাদাড় উঠেছে কেঁপে। শরীরময় ছড়িয়ে পড়েছে যৌবনের উত্তাল উচ্ছলতা-উদ্যমতা। তাই তো মন উদাস করা কোকিলের কুহুতান নিয়ে যাবে দূরে কোন অশ্বত্থ আর বটচ্ছায়ায়। যেখানে দখিনা ঝিরঝির বাতাসে খুঁজে ফিরবে প্রিয়া আর সোনামণির আদুরে মুখখানি। বসন্তের উষ্ণতায় আমের মুকুল আজ মঞ্জুরিত-গুঞ্জরিত। গিরি-শৃঙ্গমালার ভেঙেছে মহৎ মৌনতা। নব পুষ্প ও পত্র-পল্লবে প্রকৃতিতে সাজসাজ রব। গণমানুষের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন ‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক/ আজ বসন্ত।’ শীতের রিক্ততা মুছে দিয়ে প্রকৃতিজুড়ে আজ সাজসাজ রব। হিমেল পরশে বিবর্ণ প্রকৃতিতে জেগে উঠছে নবীন জীবনের ঢেউ। নীল আকাশ সোনাঝরা আলোর মতই হৃদয় আন্দোলিত। আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে..। ‘আহা আজি এ বসন্তে /কত ফুল ফোটে কত বাঁশি বাজে/ কত পাখি গায়..।’ নব পুষ্প পত্র-পল্লবে, প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে উঠেছে। ঋতুরাজ বসন্তের দিনগুলো মধুরেণ মায়াবী এক আবেশে ঘিরে রাখবে বৃক্ষ, লতা, পাখ-পাখালি আর মানুষকে। এ ফাগুন সুখের বীজ বুনে দেবে সবার মনে। সাগর, নদী, ভূ-ভাগ গ্রীষ্মের তাপবাষ্পে নিঃশ্বাস নেবার আগে এ বসন্তের ফালগুনে পায় শেষ পরিতৃপ্তি। নৈসর্গিক প্রকৃতি বর্ণচ্ছটায় অপরূপ হয়ে ওঠে। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতই বাঙালি তরুণ মনে লাগে দোলা। হৃদয় হয় উচাটন। ফুল ফুটবার পুলকিত দিন বসন্ত। বন-বনান্তে, কাননে-কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহল, আর বর্ণাঢ্য সমারোহ। ‘ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো’_ কবিগুরুর এ পুলকিত পঙ্ক্তিমালা বসন্তেই কি সকলের বেশি মনে পড়ে? বনে বনে রক্তরাঙা শিমুল-পলাশ, অশোক-কিংশুকে বিমোহিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়_ ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/ খুনেরা ফাগুন..।’ বসন্ত বাতাসে পুলকিত ভাটিবাংলার কণ্ঠ শাহ আবদুল করিম গেয়ে ওঠেন_ ‘বসন্ত বাতাসে… সই গো / বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’ বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি সেই অনাদিকাল থেকেই। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই পেয়েছে নানা বৈচিত্র্যে। আমাদের ঋতুরাজ বসন্ত হৃদয়ের বন্ধন সৃষ্টির প্রেরণা। বসন্তের মাতাল হাওয়ায় যাদের মন-ময়ূরী বেশি আন্দোলিত হয়ে ওঠে, তারা তরুণ-তরুণী। তাই তো দখিনা বাতাসে যখন ভেসে আসে উদাস করা কোকিলের কুহুতান, তখন তারা অগোচরেই গেয়ে ওঠে_ ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/ প্রেম করেছি আমি।’ কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা বসন্তের আবেশেই বজ্র নির্ঘোষে ঘোষণা দেয়_ ‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।’ বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে পলাশের শাখে গলা ছেড়ে ডাক দেয়া কৃষ্ণ কোকিলের কুহুতান গাঁও-গেরামের নিত্য চিত্র। কিন্তু ইট-কাঠ-পাথরে গড়া যান্ত্রিক-কৃত্রিম নগরীতে ব্যস্ত মানুষের কানে তা কতটাই বা পেঁৗছে! তবু কি পিছিয়ে থাকে নগরবাসী? এই শহরে বৃক্ষের সি্নগ্ধতা কিংবা কুঁড়িদের নাচনের অনুপস্থিতি যতই থাকুক, প্রিয়ার কমনীয় অঙ্গে নিশ্চিতই আজ শোভিত হবে লতানো শাড়ি; প্রিয়’র রোমশ শরীরে উঠবে বাহারি নকশার রঙিন পাঞ্জাবি। প্রিয়’র দক্ষিণ বাহুকে প্রিয়া তার কোমল-উত্তর হস্তে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমী, রমনা-সোহরাওয়ার্দী-চন্দ্রিমা উদ্যান অথবা টিএসসি, শহীদ মিনার, রবীন্দ্র সরোবরে রেশমি কেশ হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে। অথবা পরম আদরে বাঁধা চুলের বেণীর দুলুনি দেবে এ-কাঁধ থেকে ও-কাঁধ। আর গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠবে_ ‘আমারে কে নিবি ভাই সঁপিতে চাই আপনারে।’ আবহমান কাল থেকে বাংলায় উদযাপিত বসন্তকে স্মরণীয় করে রাখতে তাই তো কর্মসূচি আর অনুষ্ঠানের কমতি থাকে না। বিশেষ করে নগরজীবনে। বাংলাদেশের সংস্কৃতির লালন কেন্দ্র বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই মূলত বসন্তের অনুষ্ঠানে ঠাসা থাকে। নগরবাসীরও মন তাই সেদিকেই পড়ে থাকে। বটতলা, শহীদ মিনার, টিএসসিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও দেশি-বহুজাতিক কোম্পানির নানা আয়োজন রয়েছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মূল অনুষ্ঠানটি হবে কলা ভবন ও টিএসসি চত্বরে। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরেও হবে নানা অনুষ্ঠান।