সাংবাদিক দম্পতি হত্যাঃ ৭৫ ঘণ্টা পরও ক্লু পায়নি পুলিশ।। অচিরেই সুসংবাদ দেয়ার আশ্বাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর!

সাংবাদিক দম্পতি হত্যাঃ ৭৫ ঘণ্টা পরও ক্লু পায়নি পুলিশ।। অচিরেই সুসংবাদ দেয়ার আশ্বাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর!

বিশেষ প্রতিনিধি,এসবিডি নিউজ 24 ডট কমঃ সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার- মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ডের ৭৫ ঘণ্টা পর ১৪ ফেব্রুয়ারী রাত ১২টা পর্যন্তও অন্ধকারে রয়েছে পুলিশ। হত্যাকান্ডের কোনো ক্লুই পায়নি পুলিশ! গত সোমবার সকালেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের দেয়া ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরো অপেক্ষা করতে বলেছেন। বলছেন, তদন্ত কাজে অগ্রগতি হয়েছে, যে কোনো সময় সুখবর শুনতে পাবেন। তেজগাঁও জোনের ডিসি ইমাম হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, এই হত্যাকান্ডে এখনো কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কাউকে আটক কিংবা গ্রেফতারও করা হয়নি। কোনো গণমাধ্যম কর্মীকে আটক, গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ দূরের কথা; সন্দেহও করা হচ্ছে না। তবে ফ্ল্যাটের নিরাপত্তা কর্মীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এদের দুজনের নাম পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ুন কবীর এবং ভবনের এক কেয়ারটেকার। গোয়েন্দা শাখার ডিসি মাহাবুবুর রহমান মঙ্গলবার ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়েছেন রুনি পরিবারকে। তিনি অবিলম্বে খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের আশ্বাস দেন বলে জানান মামলার বাদী নওশের রোমান। এছাড়া মহানগর পুলিশ আবারো এক বিবৃতিতে নিহত দম্পতির কোনো সহকর্মী কিংবা অন্য কারো কাছে এ লোমহর্ষক ঘটনা সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য কিংবা হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে সহায়ক কোনো তথ্য জানা থাকলে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সরবরাহের অনুরোধ করেছে। নিহত সাংবাদিক দম্পতির ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এবং এর আগে সোমবার সিআইডির দফতর থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রক্তের নমুনা রিপোর্ট ও কয়েকটি নিরাপত্তা শনাক্তকরণ টেস্ট রিপোর্ট পৌঁছেছে তদন্তকারীদের হাতে। সব ধরনের রিপোর্ট পৌঁছলেও গোয়েন্দা পুলিশ এ দম্পতি হত্যা মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেনি। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ তার রিপোর্টে বলেন, সাগর সরওয়ারের শরীরের সামনের অংশে ১১টি ও পেছনের অংশে ১১টি ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। এছাড়া অসংখ্য ছোট আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেগুলো শরীরের ভেতরে বিদ্ধ হয়নি। তবে শরীরের বাইরের অংশে জখম ও রক্তক্ষরণ হয়েছে। মেহেরুন রুনির পেটে দুটি গভীর ক্ষত পাওয়া যায়। কপালের ওপরের অংশে রয়েছে দুটি ছোট ক্ষত। দুজনেরই শরীরের প্রধান নালি কেটে যাওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মারা গেছেন।

ডিএমপি সদর দফতরে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে গোয়েন্দা সংস্থা কর্মকর্তাসহ পদস্থ কর্মকর্তাদের এক সমন্বয় বৈঠকে হত্যাকান্ড সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বলা হয়, এখনো খুনের প্রকৃত মোটিভ পাওয়া যায়নি। খুনে জড়িতদেরও শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড এখনো ক্লুলেস বলা যায়। তবে গোয়েন্দা পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই রহস্য উদ্ঘাটনের সম্ভাবনা রয়েছে। গোয়েন্দা তদন্তকারীরা একাধিক সূত্রের পেছনে ঘুরছে। এসব সূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলেই রহস্য উদ্ঘাটন এবং ঘাতকদের দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।

এদিকে এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ এবং খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে ফুঁসে উঠছে সারাদেশ। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও সাধারণ মানুষ খুনিদের গ্রেফতার দাবিতে মাঠে নেমেছেন। মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্যদিয়ে তারা খুনিদের গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। সাংবাদিক নেতারা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় দিয়েছেন। এরপর তারা কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা কী যেন লুকাতে চাচ্ছে। হয়ত তারা কোনো চাপের মধ্যে আছে যা তারা প্রকাশও করতে পারছে না; কিন্তু সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, খুনি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন তাকে গ্রেফতার করতে হবে। এদিকে হত্যাকান্ডের ৪ দিন পর পুলিশ দাবি করেছে এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় বাড়ির তিন নিরাপত্তারক্ষী ও কর্মচারী আটক হয়েছে। পুলিশ বলেছে, নিহত সাগরের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও একটি নোটবুক খোয়া গেছে বলে মামলার বাদী রোমান জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তাসম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। দুর্বৃত্তরা সাগর-রুনির শিশুপুত্র মেঘের চোখের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে তাদেরকে খুন করে। শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। সোমবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময় শেষ হয়। ঠিক ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর সোমবার দুপুরে আইজিপি হত্যাকান্ডের তদন্ত সম্পর্কে বলেন, প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে; কিন্তু তদন্তের স্বার্থে কিছু বলা যাচ্ছে না। নিজের বেঁধে দেয়া সময় অতিক্রান্ত হওয়ার আরো ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, আপনারা অপেক্ষা করুন; যে কোনো সময় সুখবর শুনতে পাবেন। তদন্ত কাজে অগ্রগতি হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে কোস্টগার্ডের ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের ব্যাপারে গুজব ছড়ানোর কোনো অবকাশ নেই। গোয়েন্দা টিমগুলো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি শিগগিরই অগ্রগতির বিষয়ে জানানোর কথা বলেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেউ গ্রেফতার না হওয়ার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান। তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেছেন, তদন্ত কাজ যেন দ্রুত হয় সে জন্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আইজিপিও বলেছেন, তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না বলে জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ কার্যালয়ে মঙ্গলবার দুপুরে তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. ইমাম হোসেন বলেছেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরা নিহতদের বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী ও কর্মচারী। এর বাইরে আর কেউ আটক নেই। তিনি বলেন, এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমের কোনো কর্মীকে সন্দেহ, আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। তিনি বলেছেন, গণমাধ্যমে এখন অনেক মানুষ কাজ করে। এ কারণে হয়ত একে অন্যকে জড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা গণমাধ্যমের কারো পিছে লাগিনি। তিনি বলেন, পুলিশ সাগর সরওয়ারের কর্মস্থল মাছরাঙা টেলিভিশনে গিয়েছিল এবং সেখানে তার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে। হত্যার ক্লু উদ্ঘাটনে কিছু পাওয়া যায় কি না সেখান থেকে তাও দেখেছে পুলিশ। তার ব্যবহৃত কম্পিউটার পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। একইভাবে মেহেরুন রুনির কর্মস্থল এটিএন বাংলায়ও পুলিশ যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। ডিসি জানান, সাংবাদিক দম্পতি পেশাগত কারণে কোনো আক্রমণের শিকার হয়েছেন কি না তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ। জ্বালানি বিটের বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ উল্লেখ করেছে। এছাড়া তিনি পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি বাহিনীর বিষয়ে যে বই লিখেছেন তার সঙ্গে এ খুনের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের প্রতিবাদ

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেও খুনিরা গ্রেফতার এবং খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক মহল। তারা বলেছেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যার সঙ্গে যতই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকুক না কেন, তাদের গ্রেফতার করে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতেই হবে। হত্যার প্রতিবাদে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন। সেখানে সাংবাদিক নেতারা বলেন, সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আরো ২৪ ঘণ্টা সময় দেয়া হল। এ সময়ের মধ্যে প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করতে না পারলে স্বরাষ্ট্র ও তথ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বিএফইউজের মহাসচিব এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেছেন, শেয়ারবাজারের পর এবার সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে সমালোচিত হচ্ছে। আজ দলমতনির্বিশেষে সবাইকে সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাইতে হবে। সাংবাদিক নেতারা বলেন, সরকার সাংবাদিকদের এটাই বোঝাতে চাইছে তোমরাও হত্যা-গুম থেকে নিরাপদ নও। একইদিন দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জাতীয় প্রেসক্লাব, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা বক্তব্য রাখেন। ওই সভায় রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব না হলে সাংবাদিকরা কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। সাংবাদিক নেতারা বলেন, খুনি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, সে যদি কোনো সাংবাদিকও হয়, তাকেও গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কোনোভাবেই খুনিকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সাংবাদিক নেতারা বলেন, খুনি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন তার পরিচয় ‘খুনি’। তারা এ হত্যাকান্ড নিয়ে বিভ্রান্তি না ছড়ানোর জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান। এমনকি মিডিয়া কর্মীদেরও সতর্ক থাকার অনুরোধ করেন।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র ১৫ ফেব্রুয়ারী বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের হলরুমে শোকসভা করবে।

বিশেষ প্রতিনিধি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।