ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৫
সেই মোগল আমল থেকে শুরু করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ সব ধরনের আন্দোলনে সিলেটের রয়েছে অবিস্মরণীয় অবদান। সর্বোপুরি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে স্বাধীনতা ও স্বাধীকার রক্ষার সংগ্রামে সিলেটের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রায় প্রতিটা আন্দোলনেই সিলেটবাসীর বা সিলেটের ভূমিকা ছিলো উল্লেখ করা মতো। এসব আন্দোলনে সিলেটের জনপ্রতিনিধিরা প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সিলেটের আপামর জনসাধারণ তাতে একাত্বতা ঘোষণা করেছেন।
ইংরেজ বিদ্রোহে সিলেটের অবদানঃ
১৭৫৭ সালে পলাশির আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে বৃটিশ বেনিয়ায়দের হাতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়। তার ঠিক ১০০ বছর পর ১৮৫৭ সালে ঘটেছিলো সিপাহী বিদ্রোহ এরই মধ্যে ১৮৩১ সালে নারিকেল বাড়িয়ায় সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ফিরিঙ্গীদের লোহার কামানের মোকাবিলা করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম বিদ্রোহ বলে আমরা পাঠ্য বই থেকেই অনেক আগে জেনেছি। কিন্তু তারও আগে ১৭৮২ সালে সিলেটে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিলেটের এই বীরোচিত বিদ্রোহের ইতিহাস পাঠ্য বইয়ের পাতায় স্থান পায়নি। তবে ইতিহাস পিপাসুদের কেউ যদি সিলেটের তৎকালীন শাসনকর্তা রবার্ট লিন্ডসের আত্মজীবনী পড়ে থাকেন তবে নিশ্চয় অবগত আছেন যে সিলেটের সেদিনের বিদ্রোহই ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ। রবার্ট লিন্ডসের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় সেদিন সম্মুখ সশস্ত্র যুদ্ধে যে ক’জন শহীদ হন তাদের মধ্যে সৈয়দ মোহাম্মদ হাদি (পীরজাদা) ও সৈয়দ মেহেদী দুই ভাই ছিলেন। তারা সিলেটে হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া নামেই পরিচিত ছিলেন। সিলেটের শাহী ইদগাহ ময়দানের উত্তর পার্শ্বের একটি টিলায় সম্মুখ যুদ্ধে তারা শহীদ হন। বর্তমানে ওই টিলাটি হাদা মিয়া মাদা মিয়ার টিলা নামেই পরিচিত। ১৭৮২ সালের মহাররম মাসে এই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিলো বলে রবার্ট লিন্ডসে এই বিদ্রোহের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক দিয়ে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে মহররমের দাঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রবার্ট লিন্ডসের আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বহু ভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী প্রথম অনুবাদ করেছেন পরে মুনতাসির মামুন আরোও বিস্থারিত ভাবে অনুবাদ করেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর অনুবাদ করা রবার্ট লিন্ডসের আত্মজীবনী থেকে কিছু অংশ হুবহু প্রকাশ করলাম।
১৭৮২ খৃষ্টাব্দের মুহররম মাস। শহরের ক’জন হিন্দু এসে জানালেন, মুহররমের দিন মুসলমানরা কোম্পানীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং মন্দির ধ্বংস করবে। তাজিয়া বিসর্জনের দিন বিকেলে কয়েকজন হিন্দু শরীরে জখমের দাগ নিয়ে আমার বাসায় ছুটে এলেন। আমি তখন কার্তুজ ভর্তি পিস্তল ও তলোয়ার হাতে নিয়ে বের হলাম। তারপর সিপাহীদের নিয়ে দ্রুতপদে ঘটনাস্থলে গেলাম। আমার দেশী জমাদারের হাতে দুইটা পিস্তল দিয়ে বললাম আমার সঙ্গে আসো। আমার বিপদ দেখলে আমার হাতে পিস্তল দেবে। আমার ধারণার অতিরিক্ত সংখ্যক বিদ্রোহীদের সমবেত দেখে আমি অবাক হলাম। আমাদের আসতে দেখে তারা পিছু হটে এক টিলার উপর শ্রেণীবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো। তাদের দলে প্রায় তিনশ লোক। আমি আমার সেপাইদের টিলার নীচে মোতায়েন করলাম। আপোষে মিটমাট সম্ভব কিনা তা দেখার জন্য আমি আমার দেশী জমাদারকে সঙ্গে নিয়ে টিলার উপরে উঠে তাদের সম্মুখীন হলাম। তাদের নেতা পীরজাদাকে বললাম, “আমার কানে এসেছে যে শহরে শান্তি ভঙ্গ হয়েছে। জেলার শাসক হিসেবে আমি তোমাদের অস্ত্র সংবরণ করে ঘরে ফিরে যতে হুকুম করছি। কাল আমি বিচার করবো”। পীরজাদা তখন গর্বিতভাবে চিৎকার করে বললো, “আমরা কি ফিরিঙ্গিদের কুকুর যে তাদের হুকুম তামিল করবো ? আজ ইংরেজ রাজত্বের দিন শেষ। আজ মরবার ও মারবার দিন।” একথা বলে সে আমার মস্তক লক্ষ্য করে তরবারি দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করলো। সৌভাগ্যবশতঃ আমি আমার তরবারী দিয়ে আঘাত প্রতিহত করলাম। কিন্তু আঘাত ফিরাতে গিয়ে আমার তরবারি ভেঙ্গে গেল। জমাদার তখন আমার হাতে পিস্তল এগিয়ে দিলো। আমি গুলি করে পীরজাদাকে ভূপাতিত করলাম। সে আমার এত কাছে ছিলো যে, তার কাপড়ে আগুন লেগে গেলো। সিপাহীরা আমার বিপদ দেখে গুলি ছুড়তে লাগল। আমি ও জমাদার দৌড়ে টিলার নীচে গিয়ে সিপাহীদের পরিচালনা করলাম। এরপর সিপাহীরা সঙ্গীন চালালো। আমার পায়ের কাছে একজন বৃদ্ধ আহত হয়ে পড়েছিলো একজন সিপাহী তাকে সঙ্গীন বিদ্ধ করতে চেয়েছিলো। আমি পা দিয়ে সরিয়ে বৃদ্ধকে রক্ষা করলাম। হাঙ্গামা শেষ হলে দেখা গেলো পীরজাদা ও তার ভাই মারা গেছেন। তাদের দলের আরও অনেকে আহত হয়েছিল। আমাদের পক্ষে একজন হত ও বার জন আহত হয়েছিল।
লাতুর লড়াইঃ
বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার অন্তর্গত লাতুতে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় অপর এক বড় বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে, তৎকালীন সময়ে সিলেটের কালেক্টর ছিলেন আর, ও, হেইড। সে সময় চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা কুমিল্লা হয়ে সিলেটে আসেন। তারা লংলার জমিদার গৌছ আলী খাঁর কাছ থেকে রসদ সংগ্রহ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন তখন বিদ্রোহের খবর পেয়ে সিলেট থেকে মেজর বিং সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করতে লাতুতে ছুটে যান। লাতু বাজারের পাশেই এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মেজর বিং ও তার পাঁচ জন সৈন্য বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়। সেই যুদ্ধে সর্বমোট ২৩ জন নিহত হয়েছিলো, বিদ্রোহীরা পরে লাতু ছেড়ে কাছাড়ে চলে যান। পরে অকুস্থল থেকে ছয়জন বিদ্রোহীদের ধরে এনে সিলেটের গোবিন্দ চরণ পার্কে প্রকাশ্যে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো।
খেলাফত আন্দোলনঃ
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরুস্কের বিপর্যয় ঘটে। সে সময়ে তুরুস্কের খেলাফত ও খলিফাকে মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতীক বলেই গণ্য করা হতো। তুরুস্কের সেই বিপর্যয়ের জন্য বৃটিশ সরকারকে মুসলমানেরা দায়ী করেন এবং তখন আরোও শক্ত ভাবে বৃটিশ বিরোধী চেতনা দানা বাঁধতে থাকে। বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিল, সভা-সমাবেশ, জুম্মার খুৎবায় বৃটিশ বিরোধী প্রচারণা শুরু হতে থাকে। এই চেতনাকে ধারণ করে গড়ে উঠা খেলাফত আন্দোলন ১৯২০-২২ সালে তুমুল আকার ধারণ করে। সিলেট অঞ্চলেও এই আন্দোলন চরম রূপ লাভ করে। খেলাফত আন্দোলনের সাথে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন যোগ হলে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন আরোও জোরদার হয়ে উঠে। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট শহরে সুরমা উপত্যকা রাষ্ট্রীয় সমিতির পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। মৌলভী আব্দুল করিম বি-এ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অধিবেশনে মওলানা আকরম খাঁ, বিপিন পাল, ডঃ সুন্দরী মোহন দাস সহ অনেকেই বক্তৃতা দেন। এই অধিবেশনে অসহযোগ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯২১ সালে মৌলভীবাজারের যোগী ডহরে অনুষ্ঠিত হয় আসাম প্রাদেশিক খেলাফত কনফারেন্স। দেশ বন্ধু সি, আর দাসের সভাপতিত্বে এই কনফারেন্সে বৃটিশ রাজের বিরোদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে বছরই সিলেটের শাহী ঈদগাহ মাঠেও বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, সে সভায় মহাত্মা গান্ধী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা মোহাম্মদ আলী প্রমূখ নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা দেন। সিলেটের আলেম ওলামা এবং নেতৃত্বস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে জেল জুলুম সহ্য করেন। সেসময়ে সিলেটের প্রতিটি মহকুমায় গঠিত হয় খেলাফত কমিটি ও সেচ্ছাসেবক বাহিনী। মহিলারাও তাদের স্বর্ণালংকার দান করে আর্থিক ভাবে অংশগ্রহণ করে এই আন্দোলনকে আরোও বেগবান করে তুলেন।
১৯২২ সালের ২৩শে মার্চ ছিলো কানাই ঘাট মাদ্রাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল। সরকার তখন ১৪৪ ধারা জারি করে ওয়াজ মাহফিল নিষিদ্ধ করার ঘোষণা করলে উদ্যোক্তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন সুরমা ভ্যালীর কমিশনার ছিলেন জে, ই ওয়েবস্টার। স্থানীয় জনগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে লাঠি সোটা নিয়ে কমিশনারকে আক্রমণ করেন। তখন কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ জনগণের উপর গুলি চালায়, পুলিশের গুলিতে ৬জন নিহত ও ৩৮জন আহত হয়েছিলেন।
চলবে…
_________________________________________________________________
পূর্বে প্রকাশিত লিংক সমূহ:–
*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট- পর্ব ০১
*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০২
*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৩
* ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৪