ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৭
জবরুল আলম সুমন:
সিলেটে রাজা বাদশা তথা মোগল আমলের অবসান হলে সিলেট অঞ্চলকে ঢাকা ডিভিশনের সাথে যুক্ত করা হয়। কিন্তু আসাম সরকারের ব্যয়ভার বেশি হয়ে পড়লে আসাম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়, তাই আসাম সরকারের ব্যয় সংকুলানের জন্য সম্পদশালী সিলেটকে ১৮৭৪ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর আসামের সাথে জুড়ে দিলে সিলেটবাসীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তখন গভর্ণর জেনারেল নর্থব্রুক সিলেটে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন। তাকে অভ্যর্থনার জন্য সিলেটের চাঁদনীঘাটে সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়, যা আজো সিলেটের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে টিকে আছে। ১৮৭৬ সালে সিলেটকে চারটি সাব ডিভিশনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৮৭৭ সালে সুনামগঞ্জ, ১৮৭৮ সালে করিমগঞ্জ (ভারত) ও হবিগঞ্জ সাব ডিভিশন খোলা হয়। সদর সাব ডিভিশনের আয়তন বড় হয়ে যাওয়ায় ১৮৮২ সালে দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা মৌলভীবাজার সাব ডিভিশন চালু হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ প্রদেশ গঠিত হলে সিলেট আসাম থেকে পৃথক হয়ে পূর্ববঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯১২ সালে আবারো পূর্ববঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সিলেট আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সিলেট আসামের সাথে যুক্ত থেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেও আসামের কট্টরপন্থী কংগ্রেস সরকার সিলেটের সাধারণ নিরীহ মুসলমানদের উপর নানামূখী নির্যাতন চালাতো। বিভিন্ন নির্যাতন ও হয়রানীর শিকার হয়ে সিলেটের আলেম সমাজ তথা সাধারণ মুসলমানগণ কংগ্রেস সরকারের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে তারই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের লক্ষ্যে সিলেটের মুসলিম সমাজ তৎপর হয়ে উঠেন। কিন্তু ভারত বিভক্তির ক্রান্তিলগ্নে আসাম প্রদেশেভুক্ত সিলেটে জমিয়তে উলামার একটি দল পাকিস্থানভূক্তির বিরোধী ছিলো। এ কারণে সিলেটবাসীর মতামত যাচাই করার জন্য গণভোটের (Referendum) আয়োজন করা হয়। সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মিঃ ডামব্রেকের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত গণভোটে গণভোট কমিশনারের দায়িত্ব দেয়া হয় মিঃ এইচ. এ. স্টর্ককে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই সোম ও মঙ্গলবার গণভোটের তারিখ নির্ধারিত হয়।
পাকিস্থানের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সিলেটের সর্বত্রই ব্যপক ভাবে প্রচার প্রচারণা চলতে থাকে। অপরপক্ষও সমান তালে তাদের প্রচারণার কার্যক্রম শুরু করে। সিলেটের বাইরে থেকেও পাকিস্থানের পক্ষে প্রচারণা চালাতে ছুটে আসেন লিয়াকত আলী, হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, চৌধুরী খালেকুজ্জামান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সেসময়ের তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই। স্থানে স্থানে সভা-সমাবেশ, মিটিং মিছিল হতে থাকে। দৈনিক আজাদ, সিলেট যুগভেরী, মাসিক আল-ইসলাহ, মর্ণিং নিউজ, আসাম হেরাল্ড পাক্ষিক প্রভাতী পত্রিকাসমুহ পাকিস্থানের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে বিশেষ করে মওলানা ভাসানীসহ, সিলেটের আব্দুল মতিন চৌধুরী, আব্দুল হামিদ, দেওয়ান বাসিত, মুহাম্মদ নুরুল হক (সম্পাদক মাসিক আল-ইসলাহ), শাহেদ আলী (সম্পাদক পাক্ষিক প্রভাতি) মওলানা রজিউর রহমান, দেওয়ান আজরফ, মাহমুদ আলী, আজমল আলী চৌধুরী, ডাঃ আব্দুল মজিদ, খায়রুন্নেছা প্রমূখ ব্যক্তিবর্গসহ তরুন ও যুবসমাজ পাকিস্থানের পক্ষে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েন। ছাত্র ও যুব সমাজ রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাকিস্থানের পক্ষে ভোট দানে ভোটারদের উৎসাহিত করে তোলেন। সেই সাথে গঠিত হলো ন্যাশনাল গার্ড বাহিনী, নেতৃত্বে ছিলেন সিলেটে আব্দুস সালাম, করিমগঞ্জে মোকাই মিয়া ও মৌলভীবাজারে আব্দুর রকিব।
চারদিক থেকে উভয় পক্ষে প্রচার-প্রচারণা জমজমাট হয়ে উঠে। পাকিস্থানের প্রতীক কুড়াল আর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ঘর। সিলেটের সর্বত্রই “আসামে থাকবো না, গুলি খেয়ে মরবো না”, “কংগ্রেস সরকার জুলুম করে, নামাজেতে গুলি করে”, “ভূতের ঘরে কুড়াল মারো” প্রভৃতি স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে। সিলেটের সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে পাকিস্থানের পক্ষে মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এখানে উল্লেখ্য যে গণভোটের কিছু দিন আগে ১৯৪৭ সালের ২৪শে এপ্রিল থানা প্রাঙ্গনে বৃটিশ পতাকা নামিয়ে পাকিস্থানের পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে আলকাস আলী নামক একজন পুলিশের গুলিতে শহীদ হলে তার শহীদ হওয়ার ঘটনাটি পাকিস্থানের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গণভোটে ব্যপক প্রভাব ফেলে।
গণভোটের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। রাত পোহালেই যে সূর্য্য ফুটে উঠবে পৃথিবীর বুকে তার আলোয় পা ফেলেই সবাই ভোট দিতে যাবে এমনি অপেক্ষায় সবাই প্রহর গুনছে ঠিক তখনি প্রকৃতির মেজাজ বিগড়ে গেলো। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলো। কিন্তু না, মাঝে মাঝে প্রকৃতিও হার মেনে যায়, সূর্য্যের আলো ফোটার সাথে সাথে কাদা-জল মাড়িয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পিচ্ছিল পথে নর-নারী সাধারণ মানুষেরা ছুটলো ভোট কেন্দ্রে, ভোট দিতে। খুবই শান্তিপুর্ণ ভাবেই নির্ধারিত টানা দুই দিন ভোট গ্রহণ শেষে ফলাফল ঘোষিত হলো। ফলাফলে পাকিস্থানের পক্ষে ভোট পড়েছে ২,৩৯,৬২৯টি আর বিরোধী পক্ষে ১,৮৪,০৪১টি। ফলাফল ঘোষণার সাথে সাথে সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, করিমগঞ্জ (ভারত) ও কাছাড় জেলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মহকুমা হাইলাকান্দির বিস্তির্ণ জনপদসহ সর্বত্রই শুরু হয় জয়ধ্বনির সাথে আনন্দ উল্লাস। কিন্তু সিলেটবাসীর জন্য এই আনন্দ স্থায়ী হলেও করিমগঞ্জ তথা করিমগঞ্জ মহকুমার পাথারকান্দি, রাতাবাড়ি, বদরপুরসহ অনেক এলাকাই সীমানা কমিশনার রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী পাকিস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। সীমান্তবর্তী এলাকার দুই পারে আত্মীয় স্বজনরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অর্থনৈতকভাবেও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এপার ওপারের বাসিন্দারা। ফলে উভয় পারেই চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। গণভোটের সময়ে সিলেটের আয়তন ৫৪৪০ বর্গ মাইল থাকলেও সীমানা পৃথকিকরণের সময় সাড়ে তিন থানা ভারতভূক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৪৭৮৫ বর্গ মাইলে। অভিন্ন সত্ত্বা, ইতিহাস ও অখন্ড ঐতিহ্যের অধিকারী সিলেটবাসী মনের মাঝে চাপা যন্ত্রণা নিয়েও আসাম প্রদেশ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্নে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের সাথে মিশে যায়, সিলেটবাসীকে খুঁজে পাওয়া যায় সব কটি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে। ১৯৮২ সালে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর সিলেট চারটি পৃথক জেলায় ভাগ হয়ে গেলেও পরবর্তিতে ১৯৯৫ সালের ১লা আগস্ট ভাগ হয়ে যাওয়া চারটি জেলা নিয়ে সিলেট বিভাগ ঘোষিত হওয়ার মাধ্যমে তা আবার একই সূতোয় গাঁথা হয়ে যায়।
চলবে…
___________________________________________________________________
পূর্বে প্রকাশিত লিংক সমূহ:–
*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট- পর্ব ০১
*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০২
*ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৩
* ইতিহাস ঐতিহ্যে আমাদের সিলেট-পর্ব ০৪